মিয়ানমারে অভ্যন্তরে প্রায় ১০ কিলোমিটার এলাকায় বাংলাদেশি মোবাইল কোম্পানির নেটওয়ার্ক রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বড় বাধা বলে মনে করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। সীমান্ত ও নাফ নদীতে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) কড়াকড়ি, নদীতে কোস্টগার্ডের টহল জোরদার ও রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় পুলিশের নজরদারি বাড়িয়েও থামানো যাচ্ছে না রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ। উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার শতাধিক দালাল চক্রের মাধ্যমে প্রতিদিনই বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে কক্সবাজার জেলায় অনুপ্রবেশ করছে রোহিঙ্গারা। টেকনাফ থানার ওসি আব্দুল মজিদ বাংলানিউজকে জানান, এ পর্যন্ত টেকনাফের প্রায় ২০ জন দালালকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে শাস্তি প্রদান করা হয়েছে।
২ বিজিবি অধিনায়ক লে. কর্নেল আবুজার আল জাহিদ বাংলানিউজকে জানান, দেশীয় দুটি মোবাইল অপারেটরের ফ্রিকোয়েন্সি মিয়ানমার সীমান্তের কিছুটা এলাকাজুড়ে রয়েছে। একারণে পাচার ও অনুপ্রবেশ রোধে শতভাগ সফলতা আসছে না। স্থানীয় সূত্র জানায়, উখিয়া ও টেকনাফের ২৪টি পয়েন্ট দিয়ে কক্সবাজার জেলার চিহ্নিত শতাধিক দালালের মুঠোফোন নির্দেশনায় প্রতিদিনই গড়ে হাজারও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করছে। মিয়ানমারের দারোগাপাড়া, মাংগালা, গৌজিবিল, রাইম্যাঘোনা, ক্যাংব্রাং, দক্ষিণ নাগাকুরা, হোয়াব্রাং, উত্তর নাগাকুরা এলাকা থেকে মিয়ানমার নাগরিকদের বাংলাদেশে নিয়ে আসছে স্থানীয় একাধিক দালাল চক্র।
বিজিবির অবস্থান নিশ্চিত হয়ে তারা মুঠোফোনে মিয়ানমারের দালালদের সাথে যোগাযোগ রেখে অনুপ্রবেশের জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়। এপারে পৌঁছে যাওয়া রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেওয়া হয় টাকা। মিয়ানমারের দারোগাপাড়া থেকে টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের দক্ষিণ জাদিমুরা হয়ে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের নিয়ে আসতে কাজ করছে জাদিমুরা এলাকার আব্দুল আমিন, নুর মোহাম্মদ, মোহাম্মদ ছৈয়দ ও ওসমান গণি। একইভাবে মংগালা ঘাট থেকে জাদিমুরা এলাকায় রোহিঙ্গাদের আনছে জাদিমুরা এলাকার মোহাম্মদ তৈয়ব, আইয়ুব, কামাল হোসেন, নুর কামাল ও বার্মাইয়া ওসমান। গউজিবিল থেকে নয়াপাড়া সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে অনুপ্রবেশ ঘটছে নয়াপাড়া এলাকার জালাল উদ্দিন, ছৈয়দুল আমিন চৌধুরী, নুরুল আমিন চৌধুরী, মোহাম্মদ ইমরান, হামিদ হোসেন, সরওয়ার কামাল, মোহাম্মদ সেলিমের নিয়ন্ত্রণে।মিয়ানমারের রাইম্যারঘোনা ঘাট থেকে নয়াপাড়া সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গাদের নিয়ে আসছে নয়াপাড়ার আব্দুল আমিন, নুরুল ইসলাম ও জাদিমুরার আমির হামজা। ক্যাংব্রাং ঘাট থেকে নাফ নদী হয়ে হ্নীলার চৌধুরী পাড়ায় রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঘটছে চৌধুরী পাড়ার চিং চু অং, কেনি অং, নাটমোরাপাড়ার জামাল উদ্দিনের হাত ধরে। মিয়ানমারের দক্ষিণ নাগাকুরা এলাকা থেকে জালিয়াপাড়া পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ করাচ্ছে দক্ষিণ ফুলের ডেইলের রুস্তম আলী, নাটমোরাপাড়ার ছৈয়দ আহমদ ও জাহিদ হোসেন। একইভাবে নাগাকুরা থেকে হোয়াব্রাং পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গারা আসছে পূর্ব সিকদারপাড়া এলাকার আনোয়ারুল ইসলাম নয়ন, সিরাজুল ইসলাম ধইল্যা, লেদা রোহিঙ্গা বস্তির বার্মাইয়া নুর, কাস্টমস্ ঘাট এলাকার সামশুল আলম ভেক্কা ও সুলিশ পাড়ার বাদশা মিয়ার সহযোগিতায়।
এছাড়াও উত্তর নাগাকুরা এলাকা থেকে হ্নীলা ইউনিয়নের মৌলভীবাজার সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে নিয়ে আসছে মুসলিমপাড়া এলাকার মোহাম্মদ আলম, নুরুল আলম ও ছৈয়দ আলম রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশে দালাল হিসেবে কাজ করছে। অপরদিকে হোয়াইক্যং ইউনিয়নের কান্জারপাড়া এলাকার একটি সিন্ডিকেটের মধ্যে জব্বার আলীর ছেলে নুরুল আমিন, আমির আলীর ছেলে হামিদ হোছন, ফরিদ আলমের ছেলে হেলাল উদ্দিন রোহিঙ্গাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে। একই ইউনিয়নের মিনাবাজারের ঝিমংখালী এলাকায় ফরিদ আলমের ছেলে মো. মিজান, মো. হোছনের ছেলে মিজানুর রহমান, মৃত আব্দু জব্বারের ছেলে মো. আমিন, বজরুখ মিয়ার ছেলে মোবারক মিয়া, আশ্রফ আলীর ছেলে আলী হামদ, আবুল কাশেমের ছেলে মো. কামাল, লম্বাবিল এলাকার বৈদ্য আব্দু রশিদের ছেলে জাফর আলম, মৃত সুলতান আহম্মদের ছেলে মমতাজ, আলী আকবরের ছেলে লালু, আব্দু জলিলের ছেলে ফরিদ আলম, আবুল হাশেমের ছেলে আয়াছ, আব্দু জলিলের ছেলে নুর হোসেন, কালা মিয়ার ছেলে ফজল, ফকির আহম্মদের ছেলে ছৈয়দ হোসেন, খারাইংগ্যাঘোনা এলাকার আবুল বশারের ছেলে আলী আকবর তার দুই ছেলে মো. রুবেল, মৃত বদন আলীর ছেলে মো. লালূ, তার মেয়ে তৈয়বা আক্তার ও রোকেয়া রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশে সহযোগিতা করছে।
রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অনুপ্রবেশের পর টেকনাফের লেদায় অবস্থিত অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শরণাথী শিবির, উখিয়া উপজেলার কুতুপালংয়ের অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরসহ জেলার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে রোহিঙ্গারাই আশ্রয় দিচ্ছে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের।
এ বিষয়ে রোহিঙ্গা প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী বাংলানিউজকে জানান, একশ্রেণির দালাল মোবাইল ফোন ব্যবহার করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশে সহযোগিতা করছেন।
২ বিজিবির অতিরিক্ত পরিচালক মেজর আবু রাসেল সিদ্দিকী বাংলানিউজকে জানান, বছর দুয়েক আগে রবি ও গ্রামীণফোনের ফ্রিকোয়েঞ্চি মিয়ানমারের মংডু শহরের ভেতরের ৫ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। পরবর্তীতে বিজিবির পক্ষ থেকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হয়। ফলে বিআরটিএ সীমান্ত এলাকায় টাওয়ার স্থাপন করতে বিজিবির অনুমোদন লাগবে বলে প্রজ্ঞাপন জারি করে। পরে দেশীয় মোবাইল অপারেটরের ফ্রিকোয়েন্সি অনেকটা কমিয়ে নেওয়া হলেও এখনো মিয়ানমারের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের মোবাইল অপারেটরের সিগন্যাল রয়েছে।
২ বিজিবি’র অধিনায়ক লে. কর্নেল আবুজার আল জাহিদ বাংলানিউজকে জানান, মোবাইল কোম্পানিগুলো জিরো পয়েন্টের কাছাকাছি সীমান্তে লোকজনের দোহায় দিয়ে ফ্রিকোয়েঞ্চি আর কমাতে চাচ্ছে না। তবে ফ্রিকোয়েঞ্চি কমানো না হলে চোরকারবারি ও পাচারকারীরা মুঠোফোনের অপব্যবহার করবে। তাই অচিরেই মুঠোফোন ফ্রিকোয়েঞ্চি আরও কমানোর জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করবো আমরা।
পাঠকের মতামত